টুরিং টেস্ট: কম্পিউটার কি কখনো পারবে বুদ্ধিমত্তায় মানুষের সমকক্ষ হতে!!!

অনেক আগে থেকেই মানুষের মনে কৌতুহল ছিল, কোন যন্ত্র কি কখনো মানুষের মত করে চিন্তা করতে পারবে? “চিন্তা করা” আসলে কি?? চিন্তা করে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়াটাই বা কী? অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আসছিল।

মানুষ ও যন্ত্র কি কখনও একই ভাবে চিন্তা করতে পারবে??

মানুষ ও যন্ত্র কি কখনও একই ভাবে চিন্তা করতে পারবে??

১৬৩৭ সালে রেনে ডে কার্তে তাঁর প্রকাশিত Discourse on the Method –এ মানুষ ও যন্ত্রের পার্থক্য করার পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে এই পদ্ধতি সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা অনেকটা এরকম-

মানুষ হয়তো এমন কোন ঘুর্ণনযন্ত্র (automata) তৈরী করতে পারবে যা কিনা শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে, এর হয়তো কিছু দৈহিক বৈশিষ্ট্য থাকবে যা দ্বারা সেটি নির্ণয় করতে পারবে তাকে কি বলা হচ্ছে, এর অন্য একটি অংশ হয়তো বলতে পারবে তাকে আঘাত করা হচ্ছে কিনা; কিন্তু বিভিন্ন তথ্যের উপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে আসা এটির পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না, যা কিনা একজন সাধারণ মানুষ খুব সাচ্ছন্দ্যের সাথে সম্পূর্ণ করতে পারে

রেনে দে কার্তে (১৫৯৬-১৬৫০) ও তাঁর প্রকাশিত  "The Discourse on the Method"

রেনে দে কার্তে (১৫৯৬-১৬৫০) ও তাঁর প্রকাশিত “The Discourse on the Method”

সময়ের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যালান টুরিং যন্ত্রের চিন্তাশক্তি নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি বের করার কথা ভাবতে শুরু করেন। আমাদের আজকের গল্প গণিতবিদ অ্যালান টুরিংয়ের সেই টুরিং টেস্ট নিয়েই।

ইংরেজ গণিতবিদ ও গবেষক অ্যালান টুরিং (১৯১২-১৯৫৪)

ইংরেজ গণিতবিদ ও গবেষক অ্যালান টুরিং (১৯১২-১৯৫৪)

এক কথায় টুরিং টেস্ট হচ্ছে এমন একটি পরীক্ষা যার মাধ্যমে জানা যায়, কোন যন্ত্রের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে কিনা। কোন একটি যন্ত্র টুরিং টেস্ট উৎরে গেছে তার মানে হচ্ছে, সেই যন্ত্রের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে, আরো ভালোভাবে বললে,যন্ত্রটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে।

একটি কল্পিত টুরিং টেস্ট

একটি কল্পিত টুরিং টেস্ট

গণকযন্ত্র বুদ্ধিমত্তা
১৯৫০ সালে অ্যালান টুরিং তাঁর গবেষণাপত্র “Computing Machinery & Intelligence(1950)” –এ প্রথম টুরিং টেস্টের কথা উল্লেখ করেন। গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পরপরই এর উপর ভিত্তি করে ব্যাপক আলোচনা-সমালচনা,তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। তবে এই গবেষণাপত্রটিকেই মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটিলিজেন্সের মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।

একটি অনুলিপিকরণ পরীক্ষা (Imitation Game)
টুরিং তাঁর গবেষণাপত্রে একটা মজার পরীক্ষার কথা উল্লেখ করেন। মনে করা যাক একটা বদ্ধ ঘরে একটি ছেলে আছে, একই রকম অন্য একটি বদ্ধ ঘরে একটি মেয়ে বসে আছে, তৃতীয় একজন ব্যক্তিকে নির্ণয় করতে হবে কোন ঘরে ছেলেটি আছে, আর কোন ঘরে মেয়েটি।

একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে ইমিটেশন গেম পরীক্ষা

একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে ইমিটেশন গেম পরীক্ষা

তৃতীয় ব্যক্তি ছেলে নাকি মেয়ে,সবার পেটে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা গুড়গুড় করছে!!! এটা আসলে আমাদের এই পরীক্ষার জন্যে খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ না!!! সবার মনে হওয়া স্বাভাবিক- এ আর এমনকি কঠিন পরীক্ষা ?? কণ্ঠ শুনেই তো বলে দেয়া যায়,কোন ঘরে ছেলে আর কোন ঘরে মেয়ে আছে। কিন্তু টুরিং এই পরীক্ষার সাথে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে, তৃতীয় ব্যক্তি ছেলেটি এবং মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করতে পারবে, তবে সেটি হতে হবে অবশ্যই লিখিত আকারে। মৌখিক কোন যোগাযোগ করা যাবে না। আর ছেলেটি এবং মেয়েটিকেও একইভাবে লিখিত উপায়ে তৃতীয় ব্যক্তিটির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তাই শুধুমাত্র কণ্ঠস্বর চেনার মাধ্যমে ছেলেটিকে আর মেয়েটিকে আলাদা করা সম্ভব হবে না, এর জন্য প্রয়োজন হবে বাইরের বুদ্ধিমত্তার।
তৃতীয় ব্যক্তি ছেলেটি এবং মেয়েটিকে লিখিত উপায়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করবে এবং তারা লিখিত উপায়ে তৃতীয় ব্যক্তিকে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকবে। তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রাপ্ত উত্তরের উপর ভিত্তি করে বলতে হবে,কোন ঘরে ছেলেটি ছিল আর কোন ঘরে ছিল মেয়েটি। প্রশ্ন হতে পারে যে কোন বিষয়ের উপর, এটি হতে পারে গণিত কিংবা কবিতার উপর অথবা হতে পারে ভালবাসা কিংবা কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের উপর!!এতক্ষণ যে পরীক্ষার কথাটি লিখলাম সেটি ছিল টুরিং টেস্টের প্রথম ধাপ। টুরিং টেস্টের দ্বিতীয় ধাপটি আরেকটু মজার এবং এটি যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত। ছেলে ও মেয়ের পরিবর্তে এই ধাপে তৃতীয় ব্যক্তিকে মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে।

একটি যন্ত্র ও একজন মানুষের মধ্যে ইমিটেশন গেম পরীক্ষা ।

একটি যন্ত্র ও একজন মানুষের মধ্যে ইমিটেশন গেম পরীক্ষা ।

ইমিটেশন গেম বা আমাদের এই অনুলিপিকরণ পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপটিকেই মূলত সত্যিকার অর্থে টুরিং টেস্ট বলা হবে। অর্থ্যাৎ তৃতীয় ব্যক্তিটি যদি তার প্রশ্ন এবং প্রাপ্ত উত্তরের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য যুক্তি দিয়ে যন্ত্র এবং মানুষকে আলাদা করতে না পারে তবে আমরা বলবো যন্ত্রটি চিন্তা করতে পারে বা যন্ত্রটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে,আর যদি পার্থক্য করার জন্য যদি কোন উল্লেখযোগ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, তবে আমরা বলতে পারি,যন্ত্রটি চিন্তা করতে পারে না,বা এর কোন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নেই।

এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, ইমিটেশন গেম-এ যন্ত্রটি অথবা মানুষটি কি ভূল উত্তর দিচ্ছে তা কিন্তু মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। যন্ত্রটি অথবা মানুষটি তার ইচ্ছানুযায়ী কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে আবার ভূল উত্তর-ও দিতে পারে। এখানে দুজনের পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যন্ত্রটি বা মানুষটি কীভাবে উত্তর দিচ্ছে। অর্থ্যাৎ তৃতীয় ব্যক্তিটি যদি দুইজনের একজনকে জিজ্ঞেস করে,তুমি কি মানুষ?? উত্তরটি যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবুও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, উত্তরটি মানুষের নাকি যন্ত্রের!

একটি যন্ত্রের চিন্তাভাবনা
প্রথমে টুরিং টেস্টের উদ্দেশ্য ছিল, “কোন যন্ত্র কি চিন্তা করতে পারে?? (Can Machines think??”) এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। টুরিংয়ের ‘ইমিটেশন গেম’ বা অনুলিপিকরণ পরীক্ষা বর্ণনা করার পর টুরিং টেস্টের প্রশ্নটা একটু অন্যভাবে করা হল-“Can machines play the imitation game?,অর্থ্যাৎ কোন যন্ত্র কি ইমিটেশন গেম-এ অংশ নিতে পারবে??”

এই শক্তিশালি সুপার কম্পিউটার গুলোকি কখনো চিন্তার মাধ্যমে মানুষের সমকক্ষ হতে পারবে??

এই শক্তিশালি সুপার কম্পিউটার গুলোকি কখনো চিন্তার মাধ্যমে মানুষের সমকক্ষ হতে পারবে??

যন্ত্র বা একটি কম্পিউটার কিভাবে কাজ করে এই সম্পর্কে যাদের একটু ভালো ধারণা আছে তারা সম্ভবত ইতিমধ্যেই একটি পদ্ধতির কথা চিন্তা করে ফেলেছে। আমরা সবাই জানি কোন যন্ত্র গাণিতিক কাজ করে প্রোগ্রামের মাধ্যমে এবং সেই প্রোগ্রামে যে নির্দশনা দেয়া থাকে, সেটি সে নির্ভূল ভাবে সম্পন্ন করে। আজকালকার কম্পিউটার গণনার কাজটি করে খুব দ্রুততার সাথে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,2GHz প্রসেসরের একটি পার্সোনাল কম্পিউটার সেকেন্ডে প্রায় 2.0X109 –টি একক গণনা সম্পন্ন করতে পারে। তাই আমাদের মনে কৌতুহল থাকতেই পারে, যেন অনেক বড় বড় যোগ-বিয়োগ,গুণভাগ দিলে কম্পিউটার খুব দ্রুত সমাধান দিবে, এবং একই সমাধান দিতে মানুষের তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী সময় লাগবে। কিন্তু এমনও হতে পারে একটি যন্ত্র ইনপুটের সাইজ নির্ণয় করে গণনা সময়টুকুও প্রোগ্রামের মাধ্যমে নির্ণয় করা হতে পারে,সেক্ষেত্রে কিন্তু কখনোই সময় দেখে কোনটি যন্ত্র আর কোনটি মানুষ- নির্ণয় করা সম্ভব হবে না। আবার কিছু গাণিতিক সমস্যা এমনও হতে পারে যা কিনা কোন যন্ত্রের চেয়ে মানুষের ক্ষেত্রে নির্ণয় করা অনেক সহজ। যেমন,কনভেক্স হালের কোন পয়েন্ট এক্সট্রিম কিনা সেটি নির্ণয় করতে কোন সাধারণ কম্পিউটার যদি O(n4) কমপ্লক্সিটির কোন অ্যালগরিদম ব্যবহার করে,তাহলে দশটি পয়েন্টের কোন কোন কনভেক্স হালের এক্সট্রিম পয়েন্তগুলো নির্ণয়ের জন্য সেটির আরও 104 এর বেশী সংখ্যক গণনা সম্পন্ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে সময় অনেক বেশী লাগবে। অপরপক্ষে, একজন সাধারণ মানুষ স্কেল পেন্সিল দিয়ে শুধুমাত্র বাইরের বিন্দুগুলো যোগ করেই কিন্তু এক্সট্রিম পয়েন্টগুলো বের করতে পারবে।

একটি কম্পিউটার কত দ্রুত একটি কনভেক্স হালের এক্সট্রিম পয়েন্ট নির্ণয় করতে পারবে, সেটি নির্ভর করবে তার ব্যবহৃত অ্যালগরিদমের উপর।

একটি কম্পিউটার কত দ্রুত একটি কনভেক্স হালের এক্সট্রিম পয়েন্ট নির্ণয় করতে পারবে, সেটি নির্ভর করবে তার ব্যবহৃত অ্যালগরিদমের উপর।

আমরাও কিন্তু টুরিং টেস্টের পরীক্ষার্থী!!!
বিশ্বাস করি আর নাই করি আমরা যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করি তারা কোন না কোনভাবে টুরিং টেস্টে অংশ নিয়েছি, না জেনেই। সেটা হয়তো ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রশনের সময়, অথবা হয়ত ইমেইলে লগ-ইন করার সময়। তখন সিস্টেমের নির্ণয় করার প্রয়োজন হয়, সত্যিই কি ঐ নির্দিষ্ট ব্যক্তি লগইন করার চেষ্টা করছে নাকি বাইরের কোন বুদ্ধিমত্তা বা প্রোগ্রাম অযাচিত ভাবে ঐ নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে লগ-ইন করার চেষ্টা করছে। সাধারণত বর্তমানে দুইটি উপায়ে এ পরীক্ষাটি করা হয়। একটা হচ্ছে ক্যাপচা চ্যালেঞ্জ। যেখানে এলোমেলো বর্ণে এক বা একাধিক শব্দ থাকে। শব্দগুলা অর্থবহ হতে হবে এমন কোন কথা নেই, আর বর্ণগুলা অবশ্যই এমন হবে যেন এটি কোন কম্পিউটারের নির্দিষ্ট font-য়ের অনুরূপ না হয়। ফলে একজন সাধারণ মানুষ কি কি বর্ণে শব্দগুলা তৈরী তা সহজেই নির্ণয় করতে পারবে কিন্তু কোন নির্দিষ্ট font-য়ের না হওয়ায় কম্পিউটার শব্দের বর্ণগুলা নির্ণয় করতে পারবে না।

ফেসবুক, ইমেইল বা অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রায়ই আমাদের এরকম CAPTCHA চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।

ফেসবুক, ইমেইল বা অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রায়ই আমাদের এরকম CAPTCHA চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।

CAPTCHA Challenge-ও কিন্তু এক প্রকার টুরিং টেস্ট।

CAPTCHA Challenge-ও কিন্তু এক প্রকার টুরিং টেস্ট।

দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সিস্টেম একটি শব্দ লগ-ইনকারীকে শোনাবে,এবং ঐ ব্যক্তিকে শব্দটি যথাযথভাবে টাইপ করে প্রমাণ করতে হবে সে মানুষ। এই পরীক্ষাটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য অনেক বিরক্তিকর হলেও ইন্টারনেট সিকিউরিটির জন্যে এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

CAPTCHA নিয়ে মানুষ কতটা বিরক্ত সে সম্পর্কিত একটি কমিক স্ট্রিপ !!!

CAPTCHA নিয়ে মানুষ কতটা বিরক্ত সে সম্পর্কিত একটি কমিক স্ট্রিপ !!!

ক্যাপচা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আরেকটি মজার কমিক স্ট্রিপ...

ক্যাপচা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আরেকটি মজার কমিক স্ট্রিপ…

যন্ত্র মানুষের পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য টুরিং টেস্ট কি একমাত্র পদ্ধতিঃ
টুরিং টেস্ট পদ্ধতি প্রকাশ পর অ্যালান টুরিং সবচেয়ে বড় যে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হচ্ছে এটি একটি সঠিক পদ্ধতি কিনা বা এর অন্য কোন বিকল্প আছে কিনা কিংবা এই পদ্ধতি আদৌ কি গ্রহণযোগ্য। যখন ১৯৫০ সালে টুরিং যন্ত্রের চিন্তা করার ক্ষমতা নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন, সেই সময় ব্যাপারটি ছিল অনেকটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত। সে সময় পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হত, চিন্তা করার ক্ষমতা শুধুমাত্র মানুষ এবং কিছু উন্নত প্রজাতির প্রাণির মাধ্যমেই সম্ভব। কিছু দার্শনিক মনে করতেন, যন্ত্রের একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে যার বাইরে একে আর উন্নত করা সম্ভব নয়। কিন্তু যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা এখন শুধু কল্পনায় নয়, বাস্তবেও এর উদাহরণ আমরা হর-হামেশাই দেখছি। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একটি দাবা খেলার প্রোগ্রাম একজন গ্রান্ডমাস্টার দাবাড়ুকেও নাস্তানাবুদ করার ক্ষমতা রাখে!!!
টুরিং টেস্টের আরেকটি সমালোচনা করা হয় গোডেলের তত্ত্বের মাধ্যমে। গোডেলের তত্ত্বানুসারে, একটি নির্দিষ্ট যুক্তি ও ক্ষমতার সিস্টেমের মধ্যে থেকে কখনই ঐ সিস্টেমের কোন তত্ত্বকে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত করা যাবে না। টুরিং এ সম্পর্কে বলেছিলেন, যদিও কোন যন্ত্রের ক্ষমতার একটি সীমা আছে,কিন্তু মানুষের বুদ্ধিমত্তার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই, তাই গোডেলের তত্ত্ব এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
একটি যন্ত্রের চিন্তা করার ক্ষমতা থাকার জন্য তার অনুভূতি থাকা কতটা জরুরী?? একটা যন্ত্র চিন্তা করতে করতে পারে,তার মানে কিন্তু এই না যে যন্ত্রটির অন্যান্য মানবিক অনুভূতি-ও আছে। সুতরাং সুখ-দুঃখ,আশা-আকাঙ্খা,ভয়ের অনুভূতি থাকা, এবং চিন্তা করতে পারার ক্ষমতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। টুরিং টেস্টের মাধ্যমে শুধুমাত্র যন্ত্রের চিন্তা করার ক্ষমতাকেই নির্ণয় করা সম্ভব, যন্ত্রের মানবিক অনুভূতি নির্ণয় নয়।

কবিতা দিয়েও রোবট ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কবিতা দিয়েও রোবট ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

একটি যন্ত্র কখনোই “এই” কাজটি করতে পারবে না। এই বিশেষ কাজটি হতে পারে প্রেমে পড়া কিংবা আইসক্রিম খাওয়ার মত একান্তই মানবিক গুণাবলি। এই কাজগুলো টুরিং টেস্টে প্রযোজ্য হবে না, কারণ ইমিটেশন গেমে কোন কাজ সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার কথা বলা হয়নি।
একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের সাপেক্ষে একজন মানুষ অসীম সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, কিন্তু একটি যন্ত্রের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা অবশ্যই সীমিত হবে। তাই টুরিং টেস্টে প্রশ্ন সংখ্যা বা ইনপুট টেস্ট কেস অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে হতে হবে।

টুরিং টেস্ট বনাম শার্লি চাইনীজ রুম
১৯৮০ সালে জন শার্লি ইমিটেশন গেমের উপর ভিত্তি করে টুরিং টেস্টের সাথে সম্পর্কিত চাইনীজ রুমের অবতারণা করেন। এটি মূলত টুরিং টেস্টের বুদ্ধিমত্তা নির্ণয়ে অক্ষমতা বের করতেই প্রকাশ করা হয়। চাইনীজ রুমে শার্লি একটি চমৎকার চিত্রকল্পের কথা কল্পনা করেন। ধরা যাক স্বয়ং শার্লি একটি বদ্ধরুমে আছে। তাকে চীনা ভাষা জানে এমন একজন লোকের সাথে চীন ভাষায় দক্ষতার উপর পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে হবে, শার্লি একবিন্দু চাইনীজ ভাষা জানে না, কিন্তু তার কাছে একটি চাইনিজ থেকে ইংরেজি অনুবাদমূলক বই আছে। তার কাছে চাইনীজ ভাষায় লেখা হিজিবিজি অক্ষরের প্রশ্ন আসলো। সে অক্ষর মিলিয়ে সেই অনুসারে আরো হিজিবিজি অক্ষরে চাইনিজ ভাষায় সঠিক উত্তর লিখে দিলো। এখন ইমিটেশন গেম অনুসারে বলা উচিৎ জন শার্লির চাইনীজ ভাষাজ্ঞান আছে, কিন্তু সেটা তো সত্যি হতে পারে না।

Searle'র চাইনীজ রুমের একটি কল্পিত চিত্র।

Searle’র চাইনীজ রুমের একটি কল্পিত চিত্র।

জন শার্লির এই চাইনীজ রুম চিত্রকল্পকে মূলত টুরিং টেস্টের একটি সমালোচক উপাদান হিসেবে ধরা হয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে টুরিং কিছু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যার কিছু কিছু বর্তমানেই ঘটছে কিংবা ঘটেছে আবার কিছু কিছু সুদূর পরাহতই রয়ে গেছে। যেমন, দাবা খেলার মত কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা তৈরী হয়েছে। এখনকার কম্পিউটার ইমিটেশন গেম খেলার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত। প্রথমবারের মত কিছু প্রযুক্তিবিদ সফল পরীক্ষা চালিয়ে কম্পিউটারের টুরিং টেস্ট উর্ত্তীর্ণ হবার কথা জানিয়েছেন।

ইদানিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ চমৎকার সব দাবার গেম তৈরী হয়েছে।

ইদানিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ চমৎকার সব দাবার গেম তৈরী হয়েছে।

তবে টুরিং ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির ফলে এমন যন্ত্র তৈরী হবে যেটি অন্যান্য যন্ত্রের জন্য প্রোগ্রাম লিখতে পারবে এবং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করবে। বর্তমানে অবশ্য এখনও সেটি কোন যন্ত্রের পক্ষে সম্ভব নয়।

টুরিং টেস্টের গুরুত্ব শুধুমাত্র কম্পিউটার বিজ্ঞান দার্শনিকতাতেই সীমাবদ্ধ নয়!
টুরিং টেস্টের ব্যবহারিক গুরুত্ব শুধুমাত্র কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের কিছু ফলিত বিষয়ের ভিতরই সীমাবদ্ধ নয়। এর কিছু সামাজিক গুরুত্ব এবং মনোবৈজ্ঞানিক প্রয়োগ-ও রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের আচরণগত পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষেত্রে সামাজিক বিজ্ঞানীরা টুরিং টেস্টের অনুরূপ কিছু পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরাও টুরিং টেস্টের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মনোরোগের কারণ ও এর প্রতিকার পদ্ধতি বের করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রও টুরিং টেস্টের পক্ষে (এবং বিপক্ষে) প্রকাশিত হয়েছে। আজকাল নিমবাজ (Nimbuzz) এর মত বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রোগ্রাম করা কিছু কথক(Chatbot) থাকে যারা বিভিন্ন প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে উত্তর দেয় এবং প্রশ্নের উপর ভিত্তি করেই প্রশ্ন করে। এই প্রোগ্রামকে সত্যিকার অর্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলা যায় না। তবুও এরা মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর ভিত্তি করেই তৈরী হয়।

কম্পিউটার কি হতে পারবে চিন্তার দিক দিয়ে মানুষের সমকক্ষ হতে!!!
১৯৫০ সালে প্রকাশিত গবেষণা পত্রে টুরিং ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, ৫০ বছর পর অর্থ্যাৎ ২০০০ সালে 100 মেগাবাইট মেমোরি স্টোরেজের কোন কম্পিউটার পাঁচ মিনিট বা তার কম সময়ব্যাপী চলা টুরিং টেস্টে ৩০ শতাংশ বিচারকদের বোকা বানাতে সক্ষম হবে। কিন্তু গত কয়েক শতক ধরে কম্পিউটারের বিশ্লেষণ ও তথ্য ধারণের ক্ষমতা সূচকীয় হারে উন্নতি হওয়া স্বত্তেও ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে কেবলমাত্র একবারই টুরিং টেস্টের বিচারক বা তৃতীয় ব্যক্তি যন্ত্র এবং মানুষের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অবশ্য এই ঘটনার কারণও আছে। এই টুরিং টেস্ট পরীক্ষায় মানুষ হিসেবে যিনি ছিলেন তিনি ইচ্ছে করেই প্রোগ্রামিং করা আলাপনের চেষ্টা করেছিলেন।
Ray Kurzweil একজন ভবিষ্যৎ বক্তা। ১৯৯০ সালে তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন ২০২০ সালেই আমরা টুরিং টেস্ট উত্তীর্ণ হতে সক্ষম এমন কম্পিউটার দেখতে পাবো। কিন্তু ২০০৫ সালে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎবাণী কিছুটা সংশোধন করে ২০২০ সালের বদলে ২০২৯ সালের কথা উল্লেখ করেন।

টুরিং টেস্ট নিয়ে শেষের কিছু গল্প
অনেক অর্থহীন বকবক করা হল। এখন মনে হয় শেষ করা উচিৎ। এতটুকু পড়ে অনেকের ধারণা হতে পারে টুরিং টেস্টের মূল বিষয়টি শুধুমাত্র কাগজে কলমে এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু সত্যিকার অর্থে টুরিং টেস্ট নিয়ে চমৎকার কিছু কাজ হচ্ছে। টুরিং টেস্টের মাধ্যমে কোন কম্পিউটার প্রোগ্রাম মানবিক চিন্তা করতে পারে কিনা তা নিয়ে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর একটি প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়। Hugh Loebner নামে এক ব্যক্তির আয়োজিত এই বার্ষিক প্রতিযোগিতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা গবেষকদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিযোগিতায় প্রথম যে কম্পিউটার প্রোগ্রাম টুরিং টেস্ট উৎরে যাবে সেই প্রোগ্রামার একটি গোল্ড মেডেল সহ এক লাখ ডলার প্রাইজমানি জিতে নিবে। এখনও যদিও কেউ এই প্রাইজটি পায়নি, তবুও প্রতিবছর যেই প্রোগ্রামটি টুরিং টেস্টে সবচেয়ে ‘মানবিক’ উত্তর দেয় সেই প্রোগ্রামারকে একটি ব্রোঞ্জ মেডেল এবং দুই হাজার ডলার প্রাইজমানি পুরষ্কার হিসেবে দেওয়া হয়। ১৯৯৬ Loebner প্রাইজ জিতে নেয়া প্রোগ্রামটির সাথে পরীক্ষার বিচারকের কথোপকথনের কিছু অংশ এরকম—

প্রোগ্রাম: So what do you do for a living?
বিচারক: I think. I do research. I write. I love. I Live.
প্রোগ্রাম: I wonder whether you think sometimes! I am feeling like the judge here!

আশার কথা প্রতি বছরই প্রথম পুরষ্কারটি আগের প্রোগ্রাম থেকে উন্নত হচ্ছে। ফলে আমরা অচীরেই টুরিং টেস্টে উত্তীর্ণ কম্পিউটার প্রোগাম দেখতে পাবো, এমন আশা করতেই পারি।
আরো একটি মজার তথ্য হচ্ছে ২০১৪ সালে ‘The Imitation Game’ নামে অ্যালান টুরিংয়ের জীবনের উপর ভিত্তি করে একটি চলচিত্র মুক্তি পাচ্ছে।

অ্যালান টুরিং নিয়ে তৈরী চলচিত্র 'The Imitation Game' ২০১৪ সালের নভেম্বরে মুক্তি পাচ্ছে।

অ্যালান টুরিং নিয়ে তৈরী চলচিত্র ‘The Imitation Game’ ২০১৪ সালের নভেম্বরে মুক্তি পাচ্ছে।

সেই চলচিত্রে অ্যালান টুরিং হিসেবে অভিনয় করছেন ‘Sherlock’ টেলিভিশন সিরিয়ালে মূল চরিত্রে অভিনয় করা জনপ্রিয় অভিনেতা ‘Benedick Cumberbatch’। সবাইকে চলচিত্রটি দেখার অনুরোধ রইল।

5 thoughts on “টুরিং টেস্ট: কম্পিউটার কি কখনো পারবে বুদ্ধিমত্তায় মানুষের সমকক্ষ হতে!!!

  1. Pingback: Roar বাংলা অ্যালান টুরিং: একজন কিংবদন্তী গণিতবিদ

  2. Pingback: অ্যালান টুরিং: এক অবহেলিত বিজ্ঞানীর গল্প – বিজ্ঞানযাত্রা

Leave a reply to howtocode.com.bd Cancel reply